কারা অভ্যন্তরে এত প্রত্যুষে তুমি কেমন করে প্রবেশ করলে, ক্রিটো! এতো অবাক করা কাণ্ড। আমাকে নিদ্রা থেকে না জাগিয়ে তুমি নিরবে বসেছিলে কেন?। ভাবছিলাম, নিশ্চিত মৃত্যুদণ্ডের কথা জেনেও একজন মানুষ কিভাবে ঘুমাতে পারে!
এতে বিস্ময়ের কি আছে, বন্ধুবর? মৃত্যুর আগমন দেখে আমার মত সত্তোরোর্ধ বৃদ্ধের কি দু:খ পাওয়া উচিত? এবার বলো, এত প্রতুষে কেন কারাকক্ষে প্রবেশ করলে ?ডেলসের যে জাহাজটি আগমনের পর আমার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়ার কথা, সে জাহাজ কি বন্দরে পৌঁছে গেছে?
না, বন্দরে এখনও পৌঁছাইনি। তবে সে জাহাজ অদ্যই এসে পৌঁছাবে। ‘হায় ঈশ্বর, আগামী দিনটিই তোমার জীবনের শেষ দিন’। বেদনায় ক্রিটোর চোখ থেকে কয়েক ফোটা জল ঝরে পড়লো।
সক্রেটিস ক্রিটোকে শান্তনা দিয়ে বললেন, দু:খ পেও না, বন্ধু। পরমেশ্বর যদি এমনই ইচ্ছাই করে থাকেন তাহলে আমি তার জন্য সর্বদা প্রস্তুত রয়েছি। কিন্তু আমার বিশ্বাস মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হতে একদিন বিলম্ব হবে। গতরাতে আমি স্বপ্নে দেখলাম শুভ্রবসন পরিহিতা শান্ত-সৌম্য এক নারীমুর্তি আমাকে আহবাণ করে বলছেন ‘ আজ থেকে তৃতীয় দিবসে তুমি উর্বর পিথিয়াভুমির উদ্দেশ্যে যাত্রা করবে।’
হ্যাঁ, এ স্বপ্নের তাৎপর্য খুবই স্পষ্ট।
আমার শেষ অনুরোধ তুমি রক্ষা করো। আমাদের জন্য চিন্তিত হয়ো না। তোমাকে সঙ্গোপনে মুক্ত করার জন্য এথেন্সের অনেক নাগরিক প্রস্তুত আছে। প্রহরিগনের উৎকোচের দাবীও তেমন অধিক কিছু নয়। তুমি কি এই ভেবে উদ্বিগ্ন হচ্ছো বন্ধু, হয়তো সরকার আমাদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করবে অথবা আরও কঠিন দণ্ডে আমাদের দণ্ডিত করবে।
আমার অর্থ ব্যয়ে তোমার অনিহা থাকলে, থিবের সিমিয়াসের সাহায্য নিতে পার, তিনি অনেক অর্থ সংগ্রহ করেছেন। সিবিস ও অন্যান্য নাগরিকগণও তোমার পলায়নে সাহায্য করার জন্য তাদের সমস্ত সম্পদ ব্যয় করতে প্রস্তুত আছেন। তোমার মৃত্যুতে শুধু আমাদেরই অপূরণীয় ক্ষতি হবেনা- সাথে সাথে অন্যান্য বিপদ ও বিপর্যয়ও দেখা দিবে।
মানুষ বলবে ক্রিটো অর্থ ব্যয় করলেই সক্রেটিসকে বাঁচাতে পারত। কিন্তু অধিকাংশ লোক এ কথা কোন দিন জানবে না যে, আমি তোমাকে কারাগার থেকে পলায়ন করার অনুরোধ করেছিলাম। প্রিয় সক্রেটিস, সে কাজ আজ রাতেই সম্পন্ন করতে হবে।
যে ঐশ্বিক শক্তি আমার সকল প্রেরণার উৎস, যে অর্ন্তরবাণী সারা জীবন আমাকে পথ দেখিয়েছে, সে বলছে ‘ সক্রেটিস, তুমি পালিয়ো না’। মৃত্যুকে মঙ্গল হিসাবে দেখাই যুক্তি সঙ্গত। কেননা ‘ হয় মৃত্যু এক অসীম শূণ্যতা এবং চেতনার অবলোপ’ নয়তো মানুষ যেমন কল্পনা করে যে, মৃত্যু হচ্ছে এক জগৎ থেকে অপর জগতে আত্মার পরিভ্রমন।
সুতারাং আমি মৃত্যুকে যদি একটি ব্যাঘাতবিহীন নিদ্রা বলে মনে করি যা স্বপ্ন দ্বারাও বিঘ্নিত নয়, তাহলে তা এক অবর্ণনীয় প্রাপ্তি। আবার মৃত্যু যদি মৃতের রাজ্যে গমন হয় তাহলে আমি নীত হবো মিনোস, ইকাস, রাডামেন্টাস ও অপরাপর দেব-পুত্রদের সম্মুখে। যদি সেখানে কবি হোমার, অরফিউস ও অন্যান্য দেব-পুত্রদের সঙ্গ পাই বিনিময়ে আমার অদেয় কিইবা থাকতে পারে। এ যদি সত্য হয়, তাহলে আমি বলবো: একবার নয়, শতবার যেন আমার মৃত্যুদণ্ড হয়।
এথেন্সের অনেক বীর সন্তানদের মৃত্যু হয়েছে অন্যায় দণ্ডে। আমি তাদের সঙ্গে বাক্যালাপ করতে পারবো। এ আমার পরম সৌভাগ্য। বন্ধুবর, ‘ তুমি আমাকেপরমেশ্বরের হাতেই অর্পন করে যাও। তার ইচ্ছাই পূর্ণ হউক। তাঁরই আদিষ্ট পথ আমাকে অনুসরন করতে দাও।’
শেষ স্নান সেরে আসলে কারানিয়মে সক্রেটিসের পায়ের শিকল খুলে দেয়া হলো। দ্বাদশ প্রভুর পরিচারক হিসাবে কারাপাল উপস্থিত হলেন। কারাপাল কক্ষমধ্যে সক্রেটিসের পাশে দাঁড়িয়ে বলতে লাগলেন। ‘ প্রিয় সক্রেটিস, যত বন্দি এ পর্যন্ত এ কারাগারে আনীত হয়েছে তাদের মধ্যে আপনার ন্যায় উত্তম, মহৎ এবং নম্র কেউ কখনও ছিল না। আমি কর্তৃপক্ষের আজ্ঞাবাহক। মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত বন্দির মুখে বিষভাণ্ড তুলে দেয়াই আমার কাজ। আমার প্রতি বিরাগভাজন হবেন না।
আমি আপনাকে শুধূ এই বলবো আপনি যেন ‘সব অনিবার্যকে সহজভাবে গ্রহন করেন।’ এই বলে কারাপাল বিদায় নিলেন। কিছুক্ষণ পর কারাপাল বিষভাণ্ড নিয়ে ফিরে এলে সক্রেটিস কারাপালকে লক্ষ্য করে বললেন ‘ দয়া করে বলুন, কিভাবে আমি অগ্রসর হবো।
প্রথমে কারাভৃত্য তাঁকে নির্দেশনা দিলেন, তিনি যেন বাক্যালাপ কম করেন, কারন অতিরিক্ত বাক্যালাপ দেহে তাপ সৃষ্টি করে ফলত অনেক সময় শুধু দুইবার নয়, এমন কি তিনবারও বিষ প্রয়োগ করতে হয়।
অতপর কারাপাল সক্রেটিসকে লক্ষ্য করে বললেন ‘ বিষপানের পর আপনি আস্তে আস্তে পায়চারি করবেন। পদচারনায় যখন আপনার পদদ্বয় ভারী হয়ে আসবে কেবল তখনই আপনি শায়িত হবেন। তা হলে বিষক্রিয়া সঠিকভাবে চলতে থাকবে’ একথা বলে কারাপাল তাঁর হাতে বিষভাণ্ড তুলে দিলো।
ধীর-শান্তভাবে তিনি কারাপালকে বললেন ‘এই পিয়ালা থেকে দেবতাদের উদ্দেশ্যে আমি কি কিছু বিষ উৎসর্গ করতে পারি ? কারাপাল বললেন ‘সক্রেটিস, আমরা তো কেবল ততটুকু বিষই তৈরী করি যতটুকু প্রয়োজন বলে বোধ হয়। তার অতিরিক্ত নয়’।
বুঝতে পারছি বন্ধু, তাই হোক। আমি কেবল আমার পরমেশ্বরকে ডেকে বলছি, ‘এ-লোক থেকে ও-লোকে আমার যাত্রাটিকে নির্বিঘ্ন করে দাও, আমার এ প্রার্থনাটি মন্জুর হোক।’ বলে নিজ মুখে বিষ ঢেলে দিলেন।
নিজ হাতে বিষপানের এই দৃশ্য দেখে ফিডো, ক্রিটো ও অন্যান্যরা কাঁদতে শুরু করলেন। এ্যপলোডোরাস সর্বক্ষণই ক্রন্দনরত ছিলেন। এবার তিনি সশব্দ আর্তনাদে ভেঙ্গে পড়লেন এবং জোরে জোরে চিৎকার শুরু করলেন। সক্রেটিস নিবির্কিার ও শান্ত। তিনি বলে উঠলেন, কী অদ্ভুদ তোমাদের ক্রন্দন। আমি তো মেয়েদের এ্জন্যই পাঠিয়ে দিলাম যেন এরূপ দৃশ্যের অবতারণা না হয়। ‘তোমরা শান্ত হও, ধৈর্য ধারন কর।’
এক পর্যায়ে তার পা দুটি অবশ হয়ে আসছে। নির্দেশমত তিনি শুয়ে পড়লেন। কারাপাল পায়ের তলদেশে বার বার চাপ দিচ্ছেন, কিন্তু তিনি কোন চাপ অনুভব করছেন না। বিষক্রিয়া ক্রমান্বয়ে হৃদযন্ত্রের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। কিছুক্ষণ পরেই তাঁর অন্তিম মুহুর্ত উপস্থিত হবে। কিছুক্ষণ আগে নিজ হাতেই কাপড় দিয়ে তার মুখখানা ঢেকে দিয়েছিলেন।
পরমুহুর্তেই মুখের আচ্ছাদন সরিয়ে নিয়ে বললেন ‘ ক্রিটো, এ্যাসক্লেপিয়াসের নিকট আমার একটি ঋন রয়েছে, তুমি তা পরিশোধ করে দিও’। বলে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করলেন।
ড. বাসার মোহাম্মদ শফিউল্লাহ
৯ ফেব্রুয়ারী, ২০২৪ খ্রি.