রোজা বা উপবাস একটি প্রাচীন ধর্মাচার। শিখ ধর্ম ছাড়া প্রায় সকল ধর্মেই ভিন্ন আঙ্গিকে রোজার অনুশিলন দেখা যায়। মুসলীমি সংস্কৃতিতে রমজান মাসের রোজা একটি বাধ্যতামুলক ঈবাদত। ইতিহাস থেকে জানা যায়, দাউদ আ. সন্তানের সুস্থতার জন্য ৭ দিন, মুছা আ. মানুষের মুক্তির জন্য সিনাই পর্বতে ৪০ দিন ও ঈসা আ. আধ্যাত্মিক উন্নয়নের জন্য মরুভূমিতে লাগাতার ৪০ দিন রোজা রেখেছিলেন।
——————
অন্যদিকে যুবরাজ সিদ্ধার্থ ধ্যানের উন্নতির জন্য, সেনেকা ও সিসিরো মানসিক পারঙ্গমতা বৃদ্ধির জন্য দীর্ঘ সময় উপোস থাকতেন। এই প্রথা প্রাচীন যুগে চীন, ইরান, রোম, মিশর, ভারত ও আরবে প্রচলিত ছিল। ইবনে ইসহাকের বই পাঠে জানা যায় যে, প্রাক-ইসলামিক আরবে বনু হাশিম গোত্রের ধনবান বিজ্ঞজনেরা বৎসরে একমাস পর্বতে তাহান্নুত ব্রত পালন করতেন।
রোজা কী?
ব্যাপকার্থে রোজা বলতে সকাল থেকে সন্ধা পর্যন্ত খাবার বর্জন ও জনন কার্যক্রম থেকে বিরতি সহ ক্রোধ, লোভ, মাৎসর্য, গর্ব, হিংসা, বিদ্বেষ, পরশ্রীকাতরতা ইত্যাদি অশোভন কর্ম থেকে বিরত থাকাকে বুঝায়। কুরআন অনুসারে (২:১৮৩) রোজার কাজ হলো মানুষকে আধ্যাতিক ও নৈতিক উন্নয়নের আরও উচ্চতর ধাপে পৌঁছে দেয়া। রোজার অনুশীলনের মাধ্যমে মানুষ আরও শান্ত-শোভন-সুন্দর মানুষে রূপান্তরিত হতে পারে। ইহুদী-খ্রিষ্টান-হিন্দু-বুদ্দদের ও অন্যান্য সংস্কৃতিতে নানা রকমের উপবাসের অনুশীলন দেখা যায় এবং তা ১২- ১৮ – ২৪- ৭২ ঘন্টা পর্যন্ত দীর্ঘ হয়ে থাকে। মুসলমানদের রমজানের ফরজি রোজা ছাড়াও স্বেচ্ছামূলক রোজা, পরিপুরক রোজা ও প্রায়শ্চিত্য রোজা পালন করতে দেখা যায়।
রোজার উপকারিতা :
১২ মাসের ১১ মাসই মুসলমানরা কম-বেশি অনিয়ন্ত্রীত বা তাকওয়াবিহীন জীবন যাপন করে থাকেন। শৃঙ্খলা ও ধৈর্যর অভাব। আচরণে ও চিন্তায় আমরা শোভন ও ব্যালান্স থাকি না। পশ্চিমা দুনিয়া তাদের পুজা-পার্বনে-বড়দিনে- সকল কিছুর ক্রয়মুল্য যেখানে নিম্নগামী রাখে মুসলমানরা সেখানে সকল কিছুর মুল্য বাড়িয়ে দেয় কিন্তু রোজার বিধান প্রকৃতপক্ষে মুসলমানদের শোভন-সুন্দর করতে চায়। কুরআন চায় এক মাসের অনুশিলনের মাধ্যমে সে যেন আরও ভাল মুসলমান হতে পারে। নিম্নে রোজার গতানুগতিক উপকারিতা সংক্ষেপে বর্ণনা করা হলো।
১. উচ্চ নৈতিকতা সৃষ্টি ( )
রমজান মাসে শুভ চিন্তা, শুভ কর্ম, শুভ আচরণ, অন্যের প্রতি ভালবাসা, পরোপকার, দলগত সেন্স, সহনশীলতা ইত্যাদি আমলের মাধ্যমে ব্যক্তি উচ্চ নৈতিকতার অধিকারী হতে পারে। এক্ষেত্রে ইতিকাফের’ ভুমিকা উল্লেখযোগ্য। ইতেকাফ মানে আংশিক নির্জনতা। ব্যক্তি ৩-৫-৭-১০ দিন মসজিদে অবস্থান করে নিজেকে সাংসারিক সকল কাজ থেকে বিরত রাখেন। ১০ দিনের একাগ্র প্রার্থনা, কুরআন পাঠ, তাসবিহ-তাহলিল, বিভিন্ন ইছিমের জপ ইত্যাদি রোজাদারের মাঝে উচ্চতর নৈতিকতা সৃষ্টি করে।
২. নিয়মানুবর্তিতার অভ্যাস ()
সঠিক সময়ে রোজার সাহরি খাওয়া ও বেলা ডুবার সাথে সাথে ইফতার করা, তারাবির নামাজ সহ ওয়াক্তিয়া নামাজ আদায় করা, কথা, চিন্তা ও কাজে সংযত হওয়া, মানুষের সাথে শোভন আচরণ করা, পরনিন্দা বর্জনসহ কাউকে আহত না করা, পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতা প্রভৃতি কারনে ব্যক্তির মাঝে সুশৃঙ্খল অভ্যাস তৈরি হয়। অজান্তে মনে একটি প্যাটার্ন তৈরী হয় যা পরবর্তী সময়ে রোজাদারকে নিয়মের শৃঙ্খলে আবদ্ধ করে ফেলে।
৩. সামাজিক গুরত্ব ()
আধ্যাত্মিক ও নৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি রমজানের সামাজিক গুরত্ব রয়েছে। তারবীর নামাজ, দলবদ্ধভাবে ইফতার করা, মাহফিল ও আলোচনা সভা ইত্যাদি কারনে মানুষের মাঝে সমতা ও ভ্রাতৃত্বের অনুভূতি জাগ্রত হয়। তারা ভাবে মানুষের মাঝে আশরাফ-আতরাফ বলে কিছু নেই। এখানে ‘সবাই ভাই ভাই’। গনসংযোগ, কুশল বিনিময়, সামাজিক মেলামেশা ইত্যাদি মাধ্যমে ভালবাসার বন্ধন দৃঢ় হয় এবং সামাজিক দূরত্ব কমতে থাকে।
০৪.স্বর্গীয় গুণের কানেক্টিভিটি ()
আল্লাহ্র অনেক গুণ। তার মাঝে ৯৯ গুণকে আমরা জানি। নিজের উপর নিজের নিয়ন্ত্রণ, নিজের হিসাব নিজে নেয়া, সবর, ক্ষমা, মোরাকাবা-মোশাহাদা, কানাআত, গউর-ফিকর ইত্যাদি তার মাঝে চিন্তাক্ষমতা বাড়িয়ে দেয় ফলত সে আল্লাহর মহিমা, ন্যাচার, অনুগ্রহের প্রকৃতি ইত্যাদি অনুভব করতে পারে। খোদার খলিফা হিসাবে সীমিত পরিসরে ঐশ^রীয় গুণকে নিজের মধ্যে রোজাদার ধারন করে। পুণ্য গুনের চর্চার মাধ্যমে আল্লাহর ফিতরতের নিকটতর হয়। রসুল স. বলেন, ‘তোমরা খোদার গুনে গুনান্নিত হও’।
৫. শারীরিক উপকারিতা ()
ব্যতিক্রমধর্মী ঘটনা ছাড়া, অধিকাংশ ক্ষেত্রে রোজা মানুষের শারীরিক উপকার করে থাকে। এক সময় মানুষের ভাবনা ছিল যে, উপোস থাকা স্বাস্থ্যের জন্য ভাল না। কিন্তু আধুনিক কালে ইহা প্রমানিত যে, নিয়মিত উপোস সেলের সেলুলার লেভেলে গুরত্বপূর্ণ রিপিয়ারিং করে থাকে। অতিরিক্ত উজনদার মানুষের উজন কমাতে ও ক্যালরী ক্ষয়ে রোজার ভুমিকা প্রশংসাযোগ্য। এ ক্ষেত্রে অটোফেজির কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। রোজায় অবিশ্বাসী অনেক মানুষও শুধু শারীরিক উপকারিতার জন্য উপবাস বা রোজা পালন করে থাকেন। যোগশাস্ত্র নানা রকমের উপবাস যেমন ওয়াটার ফাষ্টিং, ফ্রুটস ফাস্টিং, ২৪ ঘন্টা উপবাস, ৪৮ থেকে ৭২ ঘন্টা উপোস ইত্যাদির অনুশিলনের পরামর্শ দেয়। রোজার মাসে শৃঙ্খলা ও নিয়মনিষ্ঠার কারনে overall শারীরিক সুস্থতা বেড়ে যায়। উপসংহারে বলা যায়, সার্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে রোজা আসলেই একটি উপকারি আমল ও অনুশীলন।
——————————-
ড. বাসার মোহাম্মদ শফিউল্লাহ
০১ রমজান, ১৪৪৫ হিজরি
১১ মার্চ, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ