সারসংক্ষেপ: পুরো বিশ্বের অর্থব্যবস্থা সুদ ভিত্তিক। দেশি ব্যাংক, বিদেশি ব্যাংক, বিশ্বব্যাংক, আন্তরজাতিক মুদ্রা তহবিল, দেশের ভিতর-বাহির অর্থনৈতিক লেনদেন ইত্যাদি সবই সুদভিত্তিক। এই নিবন্ধে মহাজনি সুদ, ব্যাংক সুদ, সুদভিত্তিক অর্থনীতি বনাম সুদবিহীন অর্থনীতির বাস্তবতা নিয়ে আলোচানা করা হয়েছে।
সক্রেটিস, প্লেটো, এরিষ্টটল, ঈসা আ. থমাস একুইনাস, কার্লমার্কস, সিসিরো ও মহাত্মা গান্ধি সবাই সুদের বিরোধিতা করেছেন। প্রথমে খৃষ্টানরা সুদকে এতটা ঘৃনা করতো যে সুদখোরকে খৃষ্টানগন তাদের কবরস্থানে কবর দিতে অনুমতি দিত না। বাজারের দূরাবস্থা, কাজে স্পৃহা হারাবার আশংকা ইত্যাদি বিবেচনায় নিয়ে প্রথমে ক্যালভিন এবং পরে প্রটেস্টান্ট ধর্মবেত্তাগন তাদের সমাজে সুদকে হালাল ঘোষনা করেন। ১৫ শতকে সাধু টমাস একুইনাস সুদকে পূণসংজ্ঞায়িত করেন।
মুসলমানরাও সুদকে মনেপ্রাণে ঘৃনা করে। ইসলামের প্রারম্ভে বৃহত্তর আরবে সুদি ব্যবসা প্রচলিত ছিল। বিদায় হজের ভাষণে রাসুল স. আপন চাচা হজরত আব্বাস রা. এর প্রাপ্যসুদ মওকুফ করে সুদ প্রথা বাতিল করেছিলেন। কুরআন সুদের ক্ষতিকর দিক লক্ষ্য করে সুদকে হারাম করেছেন এবং মানি লেণ্ডারদের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করেছেন। (২:২৭৫, ২৭৮, ২৭৯, ৩০:৩৯) রাসুল সুদদাতা, সুদগ্রহীতা ও মধ্যসত্ব সবাইকে অভিশাপ দিয়ে সুদ খাওয়াকে মায়ের মাথে যিনাহ করার মত গোনাহের কাজ মনে করেছেন।
সুদ কি?
সহজ ভাষায় সুদ হলো টাকার ব্যবহার মুল্য। অর্থনীতিবিদের মতে সুদ হলো cost of borrowing money or the return on investment for lending money. আর টাকা দুটো ধরনে বাজারে চলমান থাকে। ১. মান লেখা কাগজি নোট ২. জমাটবদ্ধ টাকা যেমন একটি গাড়ি। কাগজি নোট কাউকে ধার দিয়ে তার ব্যবহার মুল্য হিসাবে আপনি টাকা আয় করতে পারেন। আবার গাড়িটি ভাড়া দিয়েও টাকা আয় করতে পারেন। দুটো প্রায় একই বিষয়। সমস্যা হলো রক্ষণশীল মুসলিম বুদ্ধিজীবিরা টাকা ধার দিয়ে বা বিনিয়োগ করে ব্যবহার মুল্য নেয়াকে বা ধারে দেয়া টাকার উপর অতিরিক্ত টাকা নেয়াকে সুদ ভাবেন। আবার গাড়িটি ভাড়া দিয়ে আয় করা বা ব্যবহার মুল্য নেয়াকে হালাল মনে করেন। কুরআনে সুদকে ‘রিবা’ বলা হয়। আরবি রিবা শব্দের অর্থ হলো বৃদ্ধি বা অতিরিক্ত। টাকা বা সম্পদের ব্যবহার মুল্যের অযোক্তিক ও আনজাষ্ট বৃদ্ধি হলো সুদ। কুরআন চেয়েছিল সুদি ব্যবসার মাধ্যমে যে অমানবিক অত্যাচার বা নি:শ্ব মানুষ আরও নি:শ্ব হয় তা চিরতরে বন্ধ করে দেয়া।
ব্যাংক সুদ ও মহাজনি সুদের পার্থক্য:
১. ব্যবস্থা ও নিয়ন্ত্রণ:
* ব্যাংক সুদ: আইনসিদ্ধ ও সরকারি নিয়ন্ত্রিত পদ্ধতির মাধ্যমে নির্ধরিারিত হয়।
* মহাজনি সুদ: সাধারণত অপ্রাতিষ্ঠিানিক ও ব্যক্তি ব্যবস্থাপনায় সম্পদান হয়।
২. সুদের হার:
ব্যংক সুদ: নির্ধারিত, সীমিত এবং সময়ভিত্তিক ( যেমন ৯%- ১২%)
মহাজনি সুদ: অনেক বেশি, অনিয়ন্ত্রিত এবং চক্রবৃদ্ধি হারে নেয়া হয়। কখনও ৩০%- ৩৫% পর্যন্ত হয়ে থাকে।
৩. ঋন প্রসেস:
ব্যাংক: ঋন নিতে প্রয়োজন হয় কাগজপত্র, জামানত এবং নির্দিষ্ট নিয়মকানুন
মহাজান: ব্যক্তিগত চেনাজানা বা জামানতের ভত্তিতে ঋন দেয় , কোন নিয়ম কানুন নেই।
৪. নৈতিকথা ও শোষণ:
bank সুদ : যদিও কুরআনের দৃষ্টিতে সুদ বা প্রদত্ত টাকার অসম প্রাপ্তি হারাম, তবুও দেশের অর্থমন্ত্রণালয় সুদের বাইরে গিয়ে লেনদেন করতে পারেনা।
মহাজনি সুদ: এটি অনেক সময় শোষনমুলক, দরিদ্র মানুষকে দরিদ্রতম বানায়, বাড়ি ও জমি হারাতে পারে।
৬ষ্ট শতাব্দীতে আরবে সুদের ধরন:
কুরআনে বণিত সুদ মহাজনি সুদের সাথে অনেকটা মিল। আরবের ধনি মানুষেরা এই ধরনের সুদের ব্যবসা পরিচালনা করতেন। তাতে গরিব শ্রেণী নি:শ্ব হতো এবং ধনিক শ্রেণি আরও ধনি হতো। ব্যাংকিং সুদ ব্যক্তি ও উদোক্তাকে প্রমোট করে। ব্যাংকিং সুদ ও আরবের মহাজনি সুদ বৈশিষ্টের দিক থেকে আলাদা। আরবের সুদ বৈশিষ্টগত দিক থেকে exploitative। কুরআন বলে ‘ হে ঈমানদারগন , তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং সুদের যা বকেয়া আছে তা পরিত্যাগ কর। আর যদি পরিত্যাগ না কর তবে আল্লাহ ও রাসুলের সাথে সুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে প্রস্তুত হয়ে যাও। যদি বিরত থাক তবে মুলধন পেয়ে যাবে।( ০২:২৭৯) তোমরা চক্রবৃদ্ধি হারে সুদ খেও না ( ০৩:১৩০) আরবের সুদি সিস্টেমটি প্রকৃত অর্থে খুবই শোষণ মুলক ছিল।
ব্যাংকিং সুদ:
ব্যাংক নিজের টাকা ও পরের টাকা নিয়ে পুঁজি গঠন করে। সে অল্প সুদে মানুষের কাছ থেকে টাকা গ্রহন করে এবং বেশি সুদে মানুষকে টাকা ধার দেয়। মানুষের জমাকৃত টাকার নিরাপত্তা বিধানও ব্যাংকের কাজ। তবে মহাজনি সুদের মত ব্যাংকাররা এতটা নিষ্ঠুর নন। সে উদোক্তাদের জন্য অল্প সুদে কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও প্রকল্প সৃষ্টির জন্য ঋণ দেন। এটা আসলেই একটি ভাল কাজ এবং টাকার ব্যবহার মুল্য মহাজনি সুদের তুলনায় অনেক কম। ব্যাংকের সবচেয়ে খারাপ দিক হলো, যার কোন সম্পদ নাই তাকে সে কোন রকমের ঋণ দেয় না। যার অনেক আছে, সে অনেক পায়। এ ক্ষেত্রে গ্রামীন ব্যাংক, ব্রাক, আশা ও অন্যান্য অর্থ লেনদেনকারী এনজিও একটু ব্যতিক্রম। তারা যার একবারে কিছুই নাই তাকেও জামানত ছাড়া চড়া সুদে ঋণ দেন।
সুদের শাস্তি:
পৃথিবীর কোন দেশেই টাকার উপর সুদ দেয়া ও সুদ নেয়া শাস্তিযোগ্য অপরাধ নয়। তবে এ কথা সত্য সকল ধর্মই সুদকে ঘৃনা করেছেন। খৃষ্টান ধর্মে প্রথমে সুদ নিষেধ থাকলেও পরবর্তিতে সুদের সংজ্ঞা পুননির্ধরণ করে ইহাকে হালাল করেছেন। খৃষ্টান ধর্মে সুদখোরের সুনির্দিষ্ট কোন শাস্তি নেই। কুরআন (০৩:১৩০) মুমিনদের চক্রবৃদ্ধিহারে সুদ খেতে নিষেধ করেছেন। আল্লাহ (২:২৭৯) কুরআনে মানি লেন্ডারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ঘোষণা দিয়েছেন। কুরআন অনুসারে সুদ খাওয়া শাস্তিযোগ্য গোনাহের কাজ। তবে চুরি, ব্যভিচার, মদ পান, মেয়েদের উপর তহম্মত লাগানো গোনাহের মত সুদের বিপরিতে সুদখোরদের দুনিয়াতে সুনিদিষ্ট শাস্তির বিধান নাই। সুদখুরদের জন্য পরলোকে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা এবং ইহজীবনে ইহার জন্য তিরষ্কার রয়েছে।
হজরত উমর রা. সুদভিত্তিক যে কোন ধরনের লেনদেন বাতিল করতে কর্মকতাদের হুকুম দিয়েছেন। জনসমক্ষে সুদদাতা-গ্রহিতাদের তিরষ্কার করতেন, অর্জিত অবৈধ মুনাফা বাজেয়াপ্ত করতেন, গ্রহিতা পক্ষকে সুদসহ মুল ফিরিয়ে দিতেন, পুনরায় কেহ সুদভিত্তিক লেনদেন করলে জরিমানা এবং প্রয়োজনে বাণিজ্য থেকে অব্যাহতি দিতেন। উমাইয়া ও আব্বাসি শাসনামলে সুদ বিষয়টি রাষ্টীয় আইনের আওতায় আসে। বিচারকগন সুদ জড়িত চুক্তি বাতিল করতেন, ক্ষতিপুরণ আদেশ দিতেন এবং আইন অমান্যকারীদের শাস্তির আওতায় আনতেন। পরবর্তি সময়ে শরিয়া কোর্ট সুদ ব্যবস্থাকে বাতিল করার চেষ্টা করেছেন। তারা সুদখুরদের সামাজিকভাবে বয়কট করেছেন, ব্যবসায় বিভিন্ন রকমের বাঁধা আরোপ করেছেন।
পাকিস্থানের পানজাবে ‘ দা পান্জাব প্রহিবিশান অব ইনটারেষ্ট অন প্রাইভেট লোন এক্ট ২০২২ ধারা ভঙ্গের ক্ষেত্রে ৩ থেকে ১০ বছরের শাস্তির বিধান রয়েছে। তাছাড়া পাকিস্থানের ফেডারেল কোর্ট সরকারকে ২০২৭ এর ভিতরে সকল ক্ষেত্রে সুদবিহীন অর্থনীতি প্রয়োগের নির্দেশ দিয়েছেন। এ ক্ষেত্রে আফগানিস্থানের কথা উল্লেখ করা যায়, ২০২৩ সালে আফগান ব্যাংকের গভর্নর মোল্লা হিদায়াতুল্লাহ বাদরি আফগানিস্থানে সব ধরনের সুদের লেনদেন নিষেধ করেছেন। সুদের জায়গায় লাভ-ক্ষতির অংশিদারিত্ব, ভাড়া ভিত্তিক চুক্তি ( ইজারা) , পণ্য বিক্রয়চুক্তি ( মুবারাহা), করজে হাসানাহ ( সুদবিহীন ঋণ) চালু করেছেন।
উপসংহার:
বর্তমান বিশ্বে ব্যাংক সুদ ও মহজনী সুদ এই দুই রকমের সুদ বাজারে চলমান দেখা যায়। ব্যাংক টাকা বিনিয়োগের জন্য নামে মাত্র সুদ ঋণগ্রহীতার কাছে আদায় করেন আর মহজনী সুদ চরম মাত্রায় সুদ আদায় করেন। ব্যাংকের বিনিয়োগ পুরোটাই সাপোর্টিভ আর মহাজন কর্তৃক টাকা লগ্নী পুরোটাই শোষণমুলক। বাংলাদেশ, পাকিস্থান, ভারত, আফ্রিকার মফস্বলে চরম মাত্রার টাকা লগ্নীর ব্যবসা দেখা যায়। ৬ষ্ঠ শতাব্দী আরবে ব্যাংকের মত কোন প্রতিষ্ঠান ছিল না। ধনি মানুষেরা টাকা বা পণ্যের বিনিময়ে চরম সুদ আদায় করতেন। তাতে গরীবেরা আরো গরিব হতো এবং শেষে সকল কিছু হারিয়ে দাসে পরিণত হতো। সম্ভবত কুরআন এই জন্যই সুদকে হারাম করেছেন এবং কুরআনে উল্লেখিত সুদ মহাজন কর্তৃক আদায়কৃত সুদের অনেকটা কাছাকাছি যা আসলেই মানব সমাজের উন্নতির প্রতিবন্ধক। সুদবিহীন অর্থব্যবস্থা কনসেপ্টটি নি:সন্দেহে সুন্দর কিন্তু পৃথিবীর বাস্তবতা এর অনুকুলে নয়। বিশেষজ্ঞ আলিম ও ইসলামি অর্থনীতিবিদগণ এই বিষয়ে আরও ভাল নির্দেশনা দিতে পারবেন।