বিজ্ঞানের অগ্রগতি ও আধুনিক মতবাদসমূহের আবির্ভাবে বিশ্বে ধর্মের জয়জয়কার অবস্থা না থাকলেও ব্যক্তি  জীবনে এখনও ধর্মের যথেষ্ট প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। প্রাচীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে মানুষের চিন্তা, আচরন, মূল্যবোধের উপর সে এখনও কর্তৃত্ব করে। এক্ষেত্রে হিন্দু, মুসলিম, বুদ্দ, খ্রিষ্টান, ইহুদি ধর্মের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। প্রতিষ্ঠান হিসাবে এদের গুরুত্ব অনেক এবং তীর্থস্থানসমূহে দর্শনার্থীর সংখ্যা ক্রমাগতভাবে বাড়ছে। মক্কা, মদিনা, আকছা, গয়া, কাশি, ভ্যাটিকান, তেরোপতি, প্যাগোডার, হাইফা হলো তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। বর্তমান বিশ্বে প্রায় দশ হাজারের মত ধর্ম রয়েছে, তার মাঝে হিন্দ, মুসলিম, বৌদ্দ, খ্রিষ্টান ধর্মালম্বী জনসংখ্যা প্রায় সাড়ে চারশ কোটি। চীনের ৫০% মানুষ দৈবধর্মে বিশ্বাস করেনা। তারা খায়-দায় ও শেষে মৃত্যুবরণ করে। দৈবধর্মে বিশ্বাসী ব্যক্তিগন সাধারণত একত্ববাদী,  ত্রিত্ববাদী, বহুত্ববাদী ও প্রকৃতি পূজারী। ধর্মগ্রন্থসমুহের মাঝে কুরআন, হিন্দুদের গীতা, খ্রিষ্টানদের বাইবেল, ইহুদিদের তওরাত, ইরানিদের জেন্দাবস্তা, শিখদের গ্রন্থসাহেব, বাহাইদের কিতাব ই আকদাস  উল্লেখযোগ্য। 

ধর্মের উৎপত্তি 

ধর্মের উৎপত্তি ঠিক কখন তার নির্দিষ্ঠ দিনক্ষন নির্ণয় করা কঠিন কাজ। তবে এক্ষেত্রে ভাববাদী ও বস্তুবাদী বিশেষজ্ঞদের ধারণা ভিন্ন। এক্ষেত্রে মানব জাতির বয়স একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বিজ্ঞানীদের মতে হোমো সাপিয়ান নামক আধুনিক মানুষের আবির্ভাব হয়েছে  প্রায় ৪০ লক্ষ বছর আগে। তার আগে হোমো ইরেক্টাস ও হোমো সাপিয়ানদের অস্তিত্বের সংগ্রামে হোমা ইরেক্টাস পরাজিত হয়ে  পৃথিবী থেকে বিলীন হয়েছে। তবে গ্রন্থধারী ধর্মসমূহের ব্যাপারে সাধারণ ঐক্যমত্য রয়েছে যে তাদের আবির্ভাব বিগত দশ হাজার বছরের মধ্যে এবং তা ডেভেলপ করেছে  মিশর, ইরাক  এলাকায়। 

কেন ও কেমন করে ধর্মের উদ্ভব হলো: এ বিষয়ে বিষেশজ্ঞ পণ্ডিতগন দুভাগে বিভক্ত। নৃবিজ্ঞানীদের ধারনা আদিম সমাজে সংশয় ও অজ্ঞতাই প্রাথমিকভাবে ধর্মের আবির্ভাবে সাহায্য করেছিল। সৃষ্টি রহস্যকে জানার মত জ্ঞান তখনও তাদের হয়নি বরং বিরূপ প্রকৃতির পিড়ন থেকে বাঁচার জন্য ধর্মের উদ্ভব হয়েছে। প্রকৃতিকে দমনের জন্য প্রথমে যাদুবিদ্যার সৃষ্টি হয় এবং যাদু বিদ্যকে কেন্দ্র করে একটি সংস্কৃতির জন্ম হয়। এভাবেই ধর্মের প্রাথমিক যাত্রা শুরু হয়। ভাববাদীদের ধারনা, মানব জাতির শৈশবে আল্লাহ তায়ালা মানব জাতির  দিকনির্দেশনার নিমিত্ত যোগ্য মানুষদের অন্তরে অনুপ্রেরনা দান করেন বা গ্রন্থ দিয়ে সাহায্য করেন। ভারতীয় ধর্মবেত্তদের মতে ঈশ্বর স্বয়ং মানবরূপ ধরে  নৈরাজ্য দূর করার জন্য ধরাধামে নেমে আসেন। তাদের মতে কলি যুগে শ্রীকৃষ্ণ ঈশ্বরের অবতার হিসাবে আগমন করেছেন। ইব্রাহিমীয় ধর্মবেত্তাদের মতে স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা মানুষের পথ নির্দেশনার জন্য যুগে যুগে বাণীবাহক প্রেরন করেন। এক্ষেত্রে মোহাম্মদ, ঈসাহ মসীহ, মুছা, সুলাইমান, দাউদ ও ইব্রাহিমের নাম উল্লখযোগ্য ।    

প্রত্যাদেশ ও প্রফেটহুড:

সেমেটিক ধর্মে মরমীয় চেতনা ও প্রত্যাদেশে বিশ্বাস করা হয়। কুরআন ও বাইবেল পাঠে তা পরিষ্কার হয়ে উঠে। মরমীয় চেতনা হলো এক ধরনের অনুভুতি বা অভিজ্ঞতা। বিষয়টি একবারেই বর্ণনাতীত। আরবি শব্দ ওয়াহি ও মরমীয় চেতনা সম্পূরক বিষয়। আরবি ভাষায় ওয়াহি শব্দটি অনুপ্রেরনা, অনুভূতি, অন্তরে কিছু জাগ্রত হওয়া, দ্রুততা, সংবাদ শ্রবন করা ইত্যাদি নানা অর্থে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। কুরআন অনুসারে ওয়াহি হলো জীবনের বিশ্বজনীন ধর্ম, যদিও এর প্রকৃতি ও স্বরূপ জীবন বিকাশের বিভিন্ন স্তরে বিভিন্ন রকম। গাছপালার বেড়ে উঠা, প্রানীজগতের অঙ্গগজানো ও বিবর্তন আর মানুষের অন্তর অন্তরের গভীর থেকে যে আলো পায়- তা সবই ওয়াহি বা অনুপ্রেরণা। কুরআনে মৌমাছির পাহাড়ে বাসা নির্মানের বুদ্ধিকে, ফারাও এর হত্যা থেকে বাচানোর জন্য মুছার ( মুছা মানে পানি থেকে টেনে উঠানো) মায়ের মুছার সমুদ্রে ভাসিয়ে দেয়ার বুদ্দিকে ওয়াহি বলেছেন। পয়গম্বরদের ক্ষেত্রে  এটি এক ধরনের মরমীয় অভিজ্ঞতা যা সাধারণ মানবীয় অভিজ্ঞতা থেকে ভিন্ন এক অখণ্ড অভিজ্ঞতা। যা ব্যক্তি জীবনের সীমা অতিক্রম করে সমষ্টিগত জীবনের মোড় ফেরাবার বা একে নতুন রূপ দেয়ার সুযোগ সন্ধান করে। পয়গম্বরগন নির্দিষ্ট দিকে একাগ্র দৃষ্টি দিয়ে মানবীয় গণ্ডী অতিক্রম করে যা কিছু শিখার তা সহ মানবীয় গণ্ডিতে ফিরে আসেন। কেহ কেহ শব্দের রেশ শুনতে পান যেন ইঙ্গিতময় ভাষা, তা থেকে অবতীর্ন বাণীর স্বরূপ ধরতে চেষ্টা করেন এবং সেই রেশ মিলিয়ে যেতে না যেতেই সকল কিছু সংগ্রহ হয়ে যায় এবং বোধগম্য হয়ে উঠে। মুতাজিলিরা ওহিকে জন্নি (ধারনা মুলক) ও আকলকে ইয়াকিনি (সঠিক) ভাবেন, ফলত তারা ধর্ম প্রবচনের উপর বুদ্ধির অগ্রাধিকার প্রদান করেন। এটা মুহুর্তের কাজ, প্রায় চোখের পলকে ঘটে এবং সমগ্র অভিজ্ঞতা এক সঙ্গে নেমে আসে। এ কারনেই এর নাম হয়েছে ওহী,  কারন ওহীর অর্থ হলে দ্রুততা। (১৯৭, খালদুন) আধুনিক মনোবিজ্ঞান হয়তো এর সুন্দর ব্যাখা দিতে পারবে। 

ইবনে খালদুন তার গ্রন্থ মোকদ্দমায় মরমীয় অভিজ্ঞতাকে বুঝাতে শারীরিক ও মানসিক সামর্থভেদে ব্যক্তিক বৈশিষ্ট্যকে তিন ভাগে ভাগ করেছেন। প্রথম প্রকার ব্যক্তি প্রকৃতিগতভাবেই আত্মিক উপলব্ধির ক্ষেত্রে দূর্বল। তার সকল প্রচেষ্টা ইন্দ্রীয়গ্রাহ্য উপলব্ধি ও তজ্জনিত ধারনার মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে নিম্নবর্গে অবস্থান করেন।

দ্বিতীয় প্রকার যারা দৈহিক ও মননজনিত গতিকেই আত্মীক উপলব্ধির দিকে ধাবিত করেন এবং এমন এক উপলব্ধির অধিকারী হন যাতে দৈহিক মাধ্যম গুলোর প্রয়োজন হয় না

এটা অধ্যাত্মবাদী স্বর্গীয় জ্ঞানের অধিকারী ব্যক্তির উপলব্ধির জগত।( ১৯৬, খালদুন) 

তৃতীয় প্রকার যারা দৈহিক ও আত্মীক উভয় দিক থেকেই সম্পূর্ণভাবে উর্ধ্বস্তরের ফেরেস্তীয় শক্তিতে রূপান্তরিত হওয়ার জন্মগত যোগ্যতা রাখেন। তাদের চেতনার দিগন্তই তারা উচ্চস্তরের শক্তিসমুহকে অবলোকন ও আত্মীকবাণী শ্রবন ও বিশেষ মুহূর্তে আল্লাহর বাণী শুনতে পান। পয়গাম্বরদের ক্ষেত্রে তাই ঘটে থাকে। ইবনে খালদুন এমনই ভেবেছেন। আল্লাহই ভাল জানেন।

নবুয়তের সমাপ্তি

মুহম্মদ স. মতানুসারে তাঁর সময়কালে মানুষের মানসিক শক্তি, বুদ্ধিমত্তা, সমাজ ও প্রকৃতি এমন একটা সময়ে এসেছে যে মানবজাতি শৈশব কাঠিয়ে যৌবনে পদার্পন করেছেন। বুদ্ধিভিত্তক যে স্ফুরন ঘটেছে তাতে নবুওতের আর প্রয়োজন নেই। তাতে প্রমানিত হয় যে মানুষকে আগামী দিনগুলোতে নিজ্স্ব বুদ্ধিভিত্তির উপর ভিত্ত করেই চলতে হবে। যে সমস্ত কারনে স্বয়ং পয়গম্বর তার প্রচারিত আদর্শে পুরোহিত প্রথা, উত্তরাধিকার সুত্রে রাজক্ষমতা প্রাপ্তি ইত্যাদি নিষেধ করেছেন। এছাড়া কুরআন ওয়াহির বাইরে জ্ঞানের উৎস হিসাবে প্রকৃতি ও ইতিহাসের প্রতি নজর দেয়ার জন্য আহবান করেছেন। তার মানে এই নয় যে মরমি অভিজ্ঞতা চিরতরে বন্ধ বরং এটি একটি জীবন্ত ব্যাপার। প্রকৃতির দিক থেকে নবুয়তের সঙ্গে তার আত্মীয়তা আছে। কিন্তু এ অভিজ্ঞতা খণ্ডিত ও ইন্দ্রজাল থেকে ভিন্ন।  

ধর্মের মূলনীতি    

সকল ধর্ম লৌকিকতা ও আধ্যাত্মিকতার সমন্বয়ে গঠিত। সাধারণত ধর্ম অতিপ্রাকৃতিক স্বত্তা, মানুষের ভ্রাতৃত্ববোধ ও মরনোত্তর জীবনে বিশ্বাস করে। ১. সকল ধর্ম ঈশ্বরে বিশ্বাস করে, ঈশ্বরের বৈশিষ্ট্য নিয়ে ধর্মপ্রবর্তকদের মাঝে মতানৈক্য রয়েছে। তারা একেশ্বরবাদি, ত্রিত্ববাদি ও বহুঈশ্বরবাদি এই তিন ভাগে বিভক্ত। ২. মরনোত্তর জীবনে বিশ্বাস করে, তাদের ভাবনা এই জীবনই শেষ কথা নয়, মৃত্যুর পর কাজের জন্য পুরস্কৃত বা তিরস্কৃত করা হবে। ৩. ভ্রাতৃত্বে বিশ্বাস করে। সকল ধর্মই কম বেশ মানব সমাজের ঐক্যে বিশ্বাসী। তাদের বিশ্বাস মানব জাতি একই ছিল, পরবর্তীতে রাজনৈতিক সমাজ স্বীয় স্বার্থে মানবজাতিতে শ্রেনীবিভাজন তৈরি করেছেন। ্‌এটা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদগন করেছেন।  সাধারণ বিশ্বাস হিসাবে ধর্মের যাত্রা শুরু হলেও 

ইহা একই সাথে শাসন ব্যবস্থা ও সভ্যতা ছিল। উদাহরন হিসেবে খ্রিষ্ঠান ও ইসলাম ধর্মের কথা বলা যায়। প্রফেটের প্রচারিত ধর্ম মক্কায় আচার ভিত্তিক একটি ধর্ম ছিল যা বহুঈশ্বরের জায়গায় একেশ্বরের ধারনা প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিল । মদিনার সনদ ও অন্যান্য ব্যবস্থার কারনে মদিনায় ইহা শাসন ব্যবস্থায় পরিবর্তিত হয়। পরবর্তী পর্যায়ে তা বিশ্ব ছড়িয়ে পরলে এক পর্যায়ে সভ্যতায় রুপান্তরিত হয়।   

ধর্মের রিচুয়াল

শাহাদা, প্রার্থনা, উপবাস, দরিদ্র কর, হজ, কদর, বরাত, ঈদ, মিলাদ,  

শাহাদা হলো আরবে প্রচলিত বিশ্বাস ত্যাগ করে হজরতের প্রচারিত মতাদর্শে প্রকাশ্য মৌখিক গোষনার মাধ্যমে বিশ্বাস স্থাপনের আনুষ্ঠানিকতা । এই শাহাদা অনেকটা আরবের গৌষ্ঠী নেতার হাতে বাইয়াতের মত নিঃশর্ত আনুগত্যের সাথে সম্পৃক্ত। বাইয়াত হলো আরবের বর্বর গোষ্ঠীসমূহ ও গোষ্ঠীনেতার মধ্যে নানাবিধ শর্ত জড়িত আনুগত্যের শপথ যাতে নেতা তার আনুগত্যের বিনিময়ে গোত্রের নিরাপত্তা প্রদান করেন। তারা দলবদ্ধ গোষ্ঠী যেখানে কোন ব্যক্তিগত সম্পদ থাকেনা। সম্পদ বা খারার যা আনেন তাতে যৌথমালিকানা থাকে। শাহাদা অনুষ্ঠানের পর পূর্ব বিশ্বাসে ফিরে যাওয়ার কোন সুযোগ থাকেনা।    

পয়গাম্বরদের আন্দোলন 

কুরআন বিশ্লেষণে দেখা যায় যে, পয়গাম্বরদের কার্যক্রম ছিল এমন এক সমাজ প্রতিষ্ঠা যেখানে বিশ্বাস, ভালবাসা, ভ্রাতৃত্ব, ঐক্, ন্যায়বিচার ও মানবিক উন্নয়ন থাকবে । যতদূর জানা যায় ইব্রাহিম, মুছা, ইছা ও মুহম্মদ স. এর  আন্দোলন ছিল নীতি-ভয়-আশা ভিত্তিক সমাজ সংস্কারের আন্দোলন। মুছা, ইছা ও মুহম্মদ তিনজনই আপামর জনতা শ্রেনীর মানুষ ছিলেন। তাদের কেউ চলমান ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের অংশ ছিলেন না। খ্রি. পূ. ত্রোয়দশ শতাব্দীতে ফারাওদের অত্যাচারে গোটা মিশরের সাধারন মানুষ অপদস্ত অপমানিত। শাসক শ্রেণীর বাইরে অধিকাংশ মানুষ ছিল দাস। তুক, ফুক, যাদুতে ভরপুর । ফারাওরা নিজেদের খোদ ঈশ্বর হিসাবে কল্পনা করতেন। তাদের অন্যায় শাসন ও শোষনের হাত থেকে বাঁচার জন্য আপামর মানুষ একজন মিসাহর অপেক্ষা করছিলেন। আল্লাহ মুছা আ.কে নেতা হিসাবে প্রেরন করে ফারাওদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ার আহবান জানালেন। ফারাও তার সভাসদকে ডেকে বললো ‘  আমার জানামতে আমার বাইরে কোন খোদা নেই। একটি উঁচু সিড়ি বানাও , আমার মুছার খোদাকে দেখতে চাই। আন্দোলনে মুছা ও সাধারণ মানুষের  জয় হয়েছিল। 

———-

 ইছার আ. জনের হাতে অভিষিক্ত হলেন। ৪০ দিন লাগাতার উপবাস ব্রত শেষে গ্যালিলির দরিদ্র কৃষক আর জেলেদের মাঝে ভালবাসার বাণী প্রচার করছিলেন। কৃষক আর জেলেদের সমাজে উচ্চ আসন ও সমানের আশ্বাস দিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি পুরোহিত শ্রেনী ও রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের রোষানলের শিকার হলেন। ভালবাসার বাণী রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা নষ্টের কারন হওয়ার অভিযোগে গ্রেপ্তারী পরওয়ানা জারী করলেন।  বার শিষ্যের একজন একটি পেনির বিনিময়ে ইছাকে রোম সম্রাটের হাতে তুলে দিলেন। রোমের উচ্চ আদালত সেনহেদ্রীন তাঁকে ক্রুশবিদ্ধ করে মৃত্যু নিশ্চিত করার আদেশ দিলেন। মৃত্যুর সময় তার কয়েকজন শিষ্য ছিল। সম্রাট কনষ্টানটাইন খৃষ্টানিটিকে রাষ্টধর্ম করলে তিনি আস্তে আস্তে সমাদৃত হতেথাকেন। আজ পৃথিবীর বিরাট অংশ তার অনুসারী

——-

ঠিক এমনিভাবে মুহাম্মদ স. এর আন্দোলন ছিল প্রকৃতিগত দিক থেকে এন্টি-পেগান ও সমাজ সংস্কার ভিত্তিক । একদিকে ইব্রাহিমীয় একত্ববাদকে মক্কায় প্রতিষ্ঠা করা, অন্যদিকে সামাজিক অবক্ষয় ও নিরাপত্তাহীনতা রোধ, দুস্থ নিপীড়িত, অনাথ মানুষের স্বার্থরক্ষা। তিনি ১০ সদস্য বিশিষ্ট মক্কার শাসন কর্তৃত্বের বা শুরার অন্তর্ভুক্ত ছিলেন না।  তিনি মেধাবী মানুষ ও সামাজিক নিরাপত্তা আন্দোলন হিলফুল ফুজুলের সদস্য ছিলেন। নবুয়ত প্রাপ্তির বেশ আগেই তিনি স্বীকৃত নেতা হিসাবে ‘আল আমিন’ এওয়ার্ডে ভূষিত হয়েছিলেন। দারিদ্রতা ও পিতৃহীনতা তার পথে একটি বড় বাঁধা ছিল। খাদিজার সাথে বৈবাহিক বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ায় তার জীবনে স্বচ্ছলতা আসে। ৬১০ খ্রি. মহাপ্রভুর নৈকট্য প্রাপ্তিতে তিনি স্বর্গীয় আইন ভিত্তিক সুষম সমাজ নির্মাণে ব্রতী হন। তাঁর আন্দোলনের অধিকাংশ সহযোদ্ধারা ছিলেন ছিলেন দরিদ্র শ্রেনীর। চরম পর্যায়ে তাকে দেশ ছেড়ে ৪৫০ কি. দূরে মরুদ্যান ইয়াসরিবে আশ্রয় নিতে হয়েছিল।  তিনি এক হাজার বেদুইন গোত্রকে একত্রিত করে মক্কায় সমতাপূর্ন নতুন সমাজ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। পৃথিবীর ইতিহাসে আইন প্রনেতা, নব সমাজ ও নব-ধর্মের সৃষ্টিতে তাঁর নাম স্বর্ণাক্ষরে লিখিত থাকবে।

ধর্ম ও কার্লমার্কস

সামাজিক সংস্কারে যদিও ধর্মসমূহ গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন তবু কার্লমার্কস সহ বিভিন্ন বাম চিন্তবীদগন ধর্মকে ব্যাপক সমালোচনা করেছেন। কার্লমার্কসের মতে খ্রিষ্ঠ ধর্মের বিরুদ্ধচারনই যতেষ্ঠ নয়, একে সমুলে বিনাশ করা দরকার শুধু এই কারনে নয় যে তারা গতিশীল বস্তু আর ক্রিয়াপরতার উর্ধ্বে  এক কল্পিত ঈশ্বরে বিশ্বাস করে বরং এই কারনে যে অন্যান্য ধর্মের ন্যায় খ্রিষ্ঠ ধর্মও সামাজিক ও অর্থনৈতিক অকল্যানকে শুধু সহ্যই করেনি বরং তাকে সমর্থন দিয়েছে। জিসাস বলেন ‘কেউ যদি তোমার বাম গালে চরপটাঘাত করে ,তাহলে ডান গালটিও পেতে  দিও।’ জার্মানের পোপ ও চার্চের বিরুদ্ধে তাঁর নানাবিধ  অভিযোগ ছিল। একথা অবশ্য সত্য যে চার্চ ও বিশপরা তাদের সময়কালে কতৃত্ব নেতৃত্ব দখলে রাখার জন্য অনেক অন্যায়কে সমর্তন দিয়েছে। কিন্তু খ্রিষ্ট ধর্মের প্রবর্তক জিসাস গ্যালিলির কৃষক ও মৎস্যজীবিদের সম্মানের আসনে উন্নীত করে স্বর্গ রাজ্য প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেছিলেন। মাক্সের যে বাণীটি পৃথিবীজুড়ে বহুল আলোচিত তা হলো ‘ ধর্ম হলো নিপীড়িত সকল সৃষ্টির আক্ষেপের দীর্ঘ নিঃশ্বাস, একটা হৃদয়হীন পৃথিবীর মর্মস্থল, রীতিমতো অন্যাধ্যাত্মিক পরিস্থিতির আত্মশক্তি। তা হলো দরিদ্রের নেশার বস্তু। ঈশ্বরের ধারনা হলো  বিকৃত সভ্যতার মৌলভিত্তি’ ( পৃ ৭৩ বিক্ষা)। তার অভিযোগ ধর্মশুধু আনুগত্যের কথা বলে, সে পরিবর্তনের কথা বলে না। সে মানুষকে দাস বানাতে চায়। ধর্ম দরিদ্রদের স্বর্গের আশ্বাস দিয়ে ভুলিয়ে রাখে। সে দরিদ্র মানুষের দারিদ্র্য দূর করতে চায় না।  ধর্মের মরনোত্তর স্বর্গরাজ্যের আশ্বাস মানুষের দুঃখ ও বেদনাকে শক্তিতে রূপান্তর করে না।  বরং ধর্ম আফিমের মত বেদনাকে হ্রাস করে ঘুম পাড়িয়ে দেয়। ফলত সমাজ পরিবর্তন হয় না। তিনি ঈশ্বরের ধারনাকে বাতিল করেছেন। তাঁর মতে অতীতের যে কান ঈশ্বর বা দেবদেবীর ধারণার একটি সাংস্কৃতিক তাৎপর্য আছে যেমন যেহোবার মাঝে ইহুদি জাতির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। জিউস ছিলেন জীবন সম্পর্কিত গ্রীক ধারনার প্রতিক এবং কুমারী মাতা ম্যারির চরিত মানসে প্রতিফলিত হয়েছে মধ্যযুগের নারীর আদর্শ। তার মতে জগৎ কোন উদ্দেশ্যবাদী সত্তা দ্বারা শাসিত ও নিয়ন্ত্রিত নয়। তা বিশ্বাস করা যায় না। (পাশ্চাত্য দর্শনের ইতিহাস,  ২য় খণ্ড পৃ ১৮৪)             

 বিশপ, রাব্বি, খতিব, ব্রাহ্মন ব্যক্তি ও শ্রেনীস্বার্থে ধর্মের অপব্যাখা করছেন, অসমতা, অন্যায় ইত্যাদিকে আশ্রয় দিয়েছেন এ কথা সত্য কিন্তু পয়গাম্বরদের মূল বিষয় ছিল কায়েমী স্বার্থবাদীদের শৃঙ্খল ভেঙ্গে এক সাম্যের সমাজ প্রতিষ্ঠা করা। এ ক্ষেত্রে ইসলামের প্রফেট মুহম্মদ স. এর কথা বিশেষ করে উল্লেখযোগ্য কারন তিনি জীবন বাজি রেখে একত্ববাদ-সাম্য ভিত্তিক আন্দোলন করেছিলেন। অবশ্য কার্লমার্কসকে ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে মন্তব্য করতে শুনা যায় নি। ইসলাম পরিবর্তনের কথা বলে, সুষম সমাজ গঠনের কথা বলে। কুরআানের প্রথম দিকের সুরাগুলোতে অনাথ, হত দরিদ্র মানুষ, দাস ও অসহায় মানুষের আর্তবেদনার প্রতিফলন দেখা যায়। আবুল বাহা ও বাহাই ধর্ম সমাজিক বৈষম্য দরিকরনে গুরত্বপূর্ণ ভুমিকা রেখেছেন।  

ধর্ম ও বিজ্ঞান

প্রায়শই দেখা যায় ধর্মের সাথে বিজ্ঞানের দ্বন্ধ। মূলত ধর্মের সাথে বিজ্ঞানের দ্বন্দ্ব থাকার কথা নয়। কারন উভয়ের লক্ষ্য মানব কল্যান। তাদের কাজের ক্ষেত্রও আলাদা। সাধারণত সমন্বয় জ্ঞানের অভাব ও শ্রেণী স্বার্থের বিঘ্নতার কারনে ধর্মীয় কর্তৃপক্ষ ও বিজ্ঞানীদের মাঝে বিভিন্ন রকমের ভুল বুঝাবুঝির সৃষ্টি হয়। পাঠকের যে কয়েকটি বিষয়ের দিকে দৃষ্টি দেয়া দরকার তা হলো যে ধর্ম ও বিজ্ঞানের মাঝে মানব কল্যানের উদ্দেশ্যগত  সম্পর্ক থাকা সত্বেও তারা দুটো পৃথক ক্ষেত্র  নিয়ে কাজ করে। ধর্মগ্রন্থের মূল কাজ হলো নৈতিকতা ও আইন ভিত্তিক সমাজ নির্মান করা। তার চরম লক্ষ্য হলো মানুষকে পার্থিব ও স্বর্গীয় পুরস্কার প্রদানের মাধ্যমে সুখী করা।  অন্য পক্ষে বিজ্ঞানের কাজ হলো পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে উন্নয়ন সহায়ক জ্ঞান তেরী করা।  সে ডগমেটিক কিছুকে প্রশ্নহীনভাবে গ্রহন করবে না। পদার্থ নিয়ে সে কাজ করে, বস্তুর বাইরে সে কিছু স্বীকার করে না । প্রত্যাদেশ ও অধিবিদ্যা তার চর্চার ক্ষেত্র নয়। সেও মানব সমাজের কল্যানের জন্য কাজ করছে। সমস্যাটা দেখা দেয় ধর্মগ্রন্থের বিজ্ঞান সংক্রান্ত নানাবিধ দৃষ্টি নিয়ে। সৃষ্টির উৎস, পৃথিবী কেন্দ্রীক বিশ্ব ও সুর্য কেন্দ্রীক বিশ্ব, প্রজাতির বিবর্তন ইত্যাদি নানাবিধ বিষয় নিয়ে। এ বিষয়ে খ্রিষ্টান ও মুসলমান ধর্মবিশেষজ্ঞদের ব্যাখাই বিভিন্ন সমস্যার জন্ম দিয়েছ। কুরান, বাইবেলের বিজ্ঞান সংক্রান্ত অনেক বাক্য মেথাফোরিক হওয়ায় ধর্মগ্রন্থের বক্তব্য সাধারন মানুষদের অনুভব করা কঠিন কাজ। তাই দ্বন্ধের পথে না হেটে বিজ্ঞানকে তার নিজস্ব গতিতে হাটতে দেয়া উচিত। পোপ খতিব ও রাব্বিদের এটা বিবেচনায় আনা দরকার যে ধর্মগ্রন্থ মূলত বিজ্ঞানের কোন গ্রন্থ নয়। এক্ষেত্রে হজরতের খেজুরের ফলন বৃদ্ধি সক্রান্ত বক্তব্য স্মরন যোগ্য। তিনি পুং ফুল ও স্ত্রী ফুলের একত্রিকরনে ফলন বৃদ্ধি পায় ধারনা পরিত্যাগে পরবর্তী বছরে ফলন কমে যাওয়ায় তিনি খেজুর চাষীদের বললেন এ ব্যাপারে তোমরাই ভাল জান। কোন সেন্সেই ধর্মীয় বাণীকে বিজ্ঞান দিয়ে ব্যাখা করা উচিত নয়। এক্ষেত্রে উলেমা সমাজ পোপ- পাদরীদের অনুসরন করে ভুল করেছে। প্যপাসি ও ইসলম এক বিষয় নয়। চার্চ রাজনৈতিক ও ব্যক্তি স্বার্থে বিজ্ঞানের সাথে দ্বন্ধে জড়িয়েছে। উলেমাদের খ্রিষ্টান পোপদের অনুসরণ নেহায়েত বোাকামি। জ্ঞান কোন স্থিতিশীল বিষয় নয়। অন্যের কাছে জ্ঞান ধার করা নিজ্ঞানতার কাজ নয়।  প্রতিদিন জ্ঞানভাণ্ডারে নতুন জ্ঞান সংযোজিত হয়ে জ্ঞানের সাম্রাজ্য সমৃদ্ধ হচ্ছে। তাই বাস্তবতার আলোকে সিদ্ধান্ত দেয়া দরকার। বিজ্ঞান ও ধর্মের দ্বান্দ্বিক অবস্থানের ক্ষেত্রে  বিশিষ্ঠ সমাজ বিজ্ঞানী অগাস্ত কোতে সমাজ পরিচালনার জন্য তিনটি বিকল্প  প্রস্তাব দিয়েছিলেন। প্রথমত বিজ্ঞান ও ধর্মের সমন্বয়, দ্বিতীয়ত চার্চের কতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা, তৃতীয়ত বিজ্ঞানকে ধর্মের স্থলাভিষিক্ত করা। জ্ঞানের অগ্রগতি,  তথ্যের সহজলভ্যতা, নতুন তত্বসমুহের আগমনে পৃথিবী এমন এক স্থানে এসে দাড়িয়েছে যে, পিছনে ফিরে গিয়ে ধর্ম বা চার্চর কতৃত্ব প্রতিষ্ঠা দিবাস্বপ্ন মাত্র। বিজ্ঞানকে ধর্মের স্থলাভিষিক্ত করাও সমস্যামুক্ত নয়। সবচেয়ে সহজ পথ হলো ধর্ম ও বিজ্ঞানের সমন্বয়ের মাধ্যমে তৃতীয় পথ তৈরি করা। 

জাতি রাষ্ট্র ও ধর্ম

শুধু সমাজ সংস্কার নয়, আরেকটি মাত্রায় পয়গামবরিত্ব শাসনের সাথেও জড়িত। এক্ষেত্রে পয়গাম্বর সুলাইমান  ও দাউদের নাম উল্লখযোগ্য। তারা উভয়ে শাসনের মাধ্যমে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ রেখেছিলে। একটু গভীর দৃষ্টিতে দেখলে এটা সহজেই বুঝা যায় যে, উভয়ের লক্ষ্য হলো শৃঙ্খলা বজায় বেখে সামাজিক ও রাষ্টীয় ব্যবস্থাকে টিকে রাখা। উভয়ের লক্ষ্য এক। যদিও তারা জীবনকে একটু ভিন্ন আঙ্গিকে দেখেন।  ধর্ম চেয়েছিল স্বজ্ঞাজাত ও বিবেকপ্রসূত আইনের মাধ্যমে সামাজিক শান্তি শৃঙ্খলা বজায় রাখা।  এ কাজে বিভিন্ন সময়ে পয়গাম্বর স. সাহায্য নিয়েছেন গৌত্রপ্রীতির। আসাবিয়া বা গোত্রপ্রীতি একটি কমন ইস্যু।  কারন শক্তিশালী গৌত্রপ্রীতি   ছাড়া ধর্মীয় শাসনকে সস্থির রাখা কঠিন বিষয়। অন্যদিকে জাতি রাষ্ট্র ধর্ম বর্ণ, জাতি, ভাষা, ভৌগোলিক পরিচয়ের ঐক্যের মাধ্যমে জনগনকে শাসন করেন। পয়গাম্বরদের শাসন ও শৃঙ্খলা জাতীয় রাষ্ট্রের শাসন ও আইনের দ্বারা আনয়ন সম্ভব। জাতীয় রাষ্ট্রের জন্মের পর ধর্মীয় শাসনের আর প্রয়োজনও থাকেনা।   

ধর্মের ঐক্য

মতাদর্শগত পার্থক্য থাকা সত্বেও সকল ধর্ম এক। তারা একর বিরুদ্ধে অন্য জন অনেক যুদ্ধ করেছে। কিন্তু বিজ্ঞানের ঘাত-প্রতিঘাতে সকল ধর্ম পরষ্পর বৈরিতা ভুলে যায়। ইতিহাসে এমনও দেখা যায় যে, খ্রিষ্টান ও মুসলমানদের পরস্পরিক শত্রুতা থাকার পরও ইসলামের উপর বিজ্ঞানের আঘাতে পাদরী মুসলমানদের পক্ষে  কথা বলেছেন। সকল ধর্ম বস্তু ও প্রকৃতির বাইরে ভিন্ন এক শক্তিতে বিশ্বাস করে। প্রাধ্যান্য বিস্তারের জন্য যদিও একটি ধর্ম আরেকটি ধর্মকে আক্রমন করেছে, রক্তপাত করেছে। উদাহরণ হিসাবে ক্রসেড ও বখতিয়ার খলজি, মুহম্মদ বিন কাসেমের উল্লেখ করা যায়। তা সত্বেও তাদের ঐক্যের জায়গাগুলো চিহ্নিত করে মিলেমিশে থাকা দরকার। কেউ কাউকে যেন আক্রমন না করে। অবশ্য বৈশ্বিক প্রেক্ষিতে ইতিমধ্যে আন্তঃমিত্রতার পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। তা না হলে নতুন উদ্ভাবিত মতবাদসমুহের আক্রমনে ধর্মের ট্রাডিশনাল ফর্মটি ক্ষতিগ্রস্থ হবে। বা শুধু আনুষ্ঠানিক ব্রতগুলো থাকবে, তার প্রধান বার্তাসমূহ হারিয়ে যাবে। এ প্রসঙ্গে হজরতের কথা স্মরণযোগ্য। তিনি বলেছিলেন ইসলাম মদিনা থেকে যেভাবে চতুর্দিকে  ছড়িয়েছিল  ঠিক সেভাবে সংকোচিত হয়ে আবার মদিনায় ফিরে আসবে।   

ধর্মের ভবিষ্যৎ 

জাতীয় রাষ্ট্রের উদ্ভব হওয়াতে ধর্মের প্রয়োজন ফুরিয়ে যায়নি। সম্ভবত কখনও ফুরাবে না। কারন শাসকগন শৃঙ্খলাবিধানের কাজে ধর্মের  ব্যবহার করে থাকেন। সমস্যা হলো তাদের অনেকে নিজেদের ধর্মকে সর্বদা নির্ভূল ভাবেন। দ্বিতীয়ত পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নিজেকে বদলাতে চান না।  আবার দু একটি ধর্ম নিজেকে একমাত্র ধর্ম হিসাবে ঠিকসই রাখতে চান। ধর্মের ধারনা ইনটুয়েশান ভিত্তিক আর বিজ্ঞানরে ধারনা পর্যবেক্ষন ভিত্তিক। বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি যদিও ধমের ক্ষতি করে তার পরেও নৈতিকতা ভিত্তিক বিষয়গুলো হয়তো ঠিকে থাকবে। কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা ধর্মের জন্য একটি বিরাট আঘাত হতে পারে। হয়তো তা মানুষের জন্য একটি নতুন ধর্মের জন্ম দিবে। সকর ধর্মের ভাল বিষয়গুলোর সমন্বয়ে কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা মানব ধর্মের উন্নয়ন ঘটাবে।  

হেরাক্লিটাসের ধর্মভাবনা ( ৫০০ খৃ. পূর্ব )

পৃথিবিতে এমন মানুষ ছিল যারা ভাবতো দেবতাদের পোষাক আছে, কণ্ঠস্বর আছে। সংস্কৃতি অনুসারে ব্যক্তি মানুষ দেবতাদের ভাবতেন। মুসলিম সুফিরা বলেন, ‘মানুষ আমাকে যেমন ভাবে আমি তেমনই’। ঘোড়াদের হাত থাকলে তারা হয়তো খোদার ছবি আকতো তাদের মত করে এবং বলতো খোদা ঘোড়ার মত। ইথিওপিয়ার দেবতার রং কালো, নাক বোঁচা। থ্রেসের লোকেরা ভাবনা, তাদের দেবতার চোখ নীল, আর চুল লাল। পৃথিবীতে অনেক এমন দেবতা রয়েছেন যাদের শরীরটা ঘোড়ার মত আর মুখটা নারীর মত। ঠিক তার বিপরিতে এমন দেবতা রয়েছেন যার শরীর মানুষের মত আর মুখ ঘোড়ার মত।   জেনোফেনিস এক ঈশ্বরে বিশ্বাস করতেন। তার ঈশ্বর আকারে ও চিন্তায় মানুষের মত নন, তিনি তার নিজ মনের বলে সবকিছু অনায়াসে নিয়ন্ত্রন করেন। জেনোফেনিস মনে করতেন, ধর্মতত্বের বিষয়গুলোর মধ্যকার সত্য  অনুধাবন করা অসম্ভব। ‘ দেবতাদের সম্পর্কে  আমি যে সব বিষয়ে কথা বলি সে সব সম্পর্কে নিশ্চিত সত্য জানে  এমন মানুষ নেই, কখনো থাকবেও না। হ্যাঁ, এমনকি যদি কোন মানুষ এমন কিছু বলে যা পুরোপুরি সত্য, তবুও সে নিজেই সেই সত্যকে জানতে পারেনা। একমাত্র অনুমান ছাড়া  কোথাও আর কিছু নেই। (পৃ-৫৬০, রাসেল রচনা-৩ , আতা ই রাব্বি)

হেরাক্লিটাস ভাবতেন, সবকিছুই একটি  নিত্য-পরিবর্তনশীল অবস্থার মধ্যে বিরাজ করছে। তিনি ছিলেন ভিন্ন ধরনের একজন মরমিবাদি। তিনি মনে করতেন, আদিবস্তু হলো আগুন; আগুনের মধ্যে যেমন করে অগ্নীশিখার জন্ম হয়, তেমনি প্রত্যেক বস্তু জন্ম হয় অন্য একটি কিছুর মৃত্যুর ফলে’। নশ্বররা অবিনশ্বর আর অবিনশ্বররা নশ্বর- নশ্বরের জন্মের মধ্যে আছে অবিনশ্বরের মৃত্যু আর নশ্বরের মৃত্যুর মধ্যে অবিনশ্বরের জন্ম। জগতে ঐক্য আছে, কিন্তু সে ঐক্য গঠিত হয় পরষ্পর বিপরিতধর্মী বস্তুগুলোর মিলন থেকে। ‘ সব বস্তুর উৎপত্তি এক অভিন্ন বস্তু থেকে, আর সেই একের উৎপত্তি সব বস্তু থেকে। কিন্তু বহুর গুরত্ব একের চেয়ে কম, এক হলো ঈশ্বর’ (পৃ-৫৬০, রাসেল রচনা-৩ আতা রাব্বি)  ইন্দ্রিয়ের কাছে নয়, বুদ্ধির সামনে একটি  শাশ্বত জগতের পুরো ধারনাটিই এসেছে পিথাগোরোসের কাছ থেকে। পিথাগোরাস না থাকলে ক্রাইষ্ট শব্দটাই আসতো না খৃষ্টানদের। (পৃ- ৫৫৮, রাসেল রচনা-৩ , আতা ই রাব্বি)

পিথাগোরাস দাবি করতেন তার প্রজ্ঞা আছে। আর তার যা ছিল  তা বস্তু সম্পর্কে জ্ঞান আর দুষ্টামির কলা কৌশল। মানব জাতির চরিত্রের  প্রতি হেরাক্লিটাসের ঘৃনার ফলে তিনি মনে করতেন যে, মানুষকে নিজেদের পক্ষে মঙ্গলজনক কাজে বাধ্য করা যায় শুধু বল প্রয়োগের মাধ্যমে। তিনি বলতেন,  ‘প্রত্যেকটি পশুকে তৃনভুমিতে নিয়ে যেতে হয় ঠেঙিয়ে।’ তার আরও একটি মন্তব্য ছিল ‘ গর্দভরা সোনা চায়না, খড় চায়’ । হেরাক্লিটাস ভাবতেন ‘ যুদ্ধই সবকিছুর জনক, সবার রাজা। যুদ্ধই কাউকে দেবতা বানায়, আরার কাউকে বানায় ক্রিতদাস। তাদের যুগে আগুন, পানি, বাতাস, মাটি সবাইকে দেবতা ভাবা হতো। এদের  সবাইকে পবিত্র মনে করা হতো।

তাঁর অধিবিদ্যা বলে ‘ এ জগৎ মানুষ-দেবতা কারো সৃষ্টি নয়। বরং তা সর্বদা বিদ্যমান ছিল, আছে এবং থাকবে। এ এক চিরন্তন আগুন, ক্ষণে জলছে, ক্ষণে নিবছে। মহাবিশ্বে এমন একটি ন্যায়বিচার আছে যার ফলে বিপরিতগুলোর দ্বন্ধে কোন পক্ষই চুড়ান্ত  বিজয় লাভ করতে পারেনা। (পৃ-৫৬৪,  রাসেল রচনা-৩ , আতা ই রাব্বি) হেরাক্লিটের ঈশ্বর দেব-দেবীদের থেকে আলাদা। ‘মানুষের পথে কোন প্রজ্ঞা নাই, কিন্তু ঈশ্বরের পথে প্রজ্ঞা আছে —— ঈশ্বর মানুষকে বলেন বাছা, এমনকি মানুষকে বলে শিশু—–  সবচেয়ে জ্ঞানী মানুষটি ঈশ্বরের তুলনায় উল্লুক। ঠিক যেমন সবচেয়ে সুন্দর উল্লুকটিও মানুষের তুলনায় কুৎসিত। ( ঐ) ‘ তুমি এক নদীতে  দুবার পা ফেলতে পারবে না, কারন তোমার উপর দিয়ে সর্বদাই নতুন জল প্রবাহিত হচ্ছে।’ প্লেটো ও এরিষ্টটল তার সাথে একমত যে, ‘ কোন কিছুরই অস্তিত্ব  সম্পুর্ণ হয়নি, সব কিছুই অস্তিত্ব লাভের প্রক্রিয়ার ভিতর দিয়ে এগোচ্ছে। ( প্লেটো) এবং কোন কিছুই অপরিবর্তিত রূপে বিরাজমান নয়। ( অ্যারিস্টটল) আধুনিক উদারপন্থি ধর্মতাত্তিক বিশ্বাস করেন যে , স্বর্গেও প্রগতি আছে এবং ঈশ্বরের মাথায়ও চিন্তাভাবনার বিকাশ ঘটছে। ( ঐ ৫৫৬, রাসেল রচনা-৩ , আতাই-রাব্বি) পরিবর্তনের প্রতি সমুদয় বিশ্বাস সত্বেও  হেরাক্লিটাস মনে করতেন যে, একটা কিছু আছে যা চিরস্থায়ী। তাদের বিশ্বাস ছিল কোন কিছুই ধ্বংশ হয়না, রুপান্তরিত হয় এবং পুনর্বিন্যাস ঘটে।

 ——————